আমাদের এই পরিবেশ-প্রকৃতি আল্লাহ তায়ালার সুমহান সৃষ্টির এক অপূর্ব নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা প্রকৃতিকে মানুষের জন্য জীবনধারণের অনুকূল, বাসযোগ্য, সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। পরিবেশ ও প্রতিবেশের অন্যতম নিয়ামক হলো উদ্ভিদ ও গাছপালা। গাছগাছালি, বৃক্ষতরু ও লতাগুল্ম থেকেই আসে আমাদের জীবনধারণ ও জীবন রক্ষার সব উপকরণ। প্রিয় নবীজি (সা.) নিজ হাতে গাছ লাগিয়েছেন, সাহাবায়ে কেরামকে গাছ লাগাতে ও বাগান করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃক্ষরোপণকে সদকায়ে হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলমান গাছ লাগায় অথবা কোনো ফসল বোনে আর মানুষ ও পশুপাখি তা থেকে খায়, এটা রোপণকারীর জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)। (এমনকি) যে কেউ যে কোনোভাবে এ থেকে (উপকার) গ্রহণ করবে তা সদকা হিসেবে গণ্য হবে। (মুসলিম : ১৫৫২)।
বৃক্ষরোপণ করা সদকায়ে জারিয়া। যত দিন পর্যন্ত রোপণকৃত গাছটি জীবিত থাকবে ঠিক তত দিন যত মানুষ ও পশুপাখি সে গাছ থেকে ফুল, ফল ও ছায়া অর্থাৎ যেকোনো ধরনের উপকার পাবে, তা রোপণকারীর আমলনামায় সদকায়ে জারিয়া হিসেবে লেখা হবে। রোপণকারী ব্যক্তি যদি মারাও যান তাহলে তাঁর আমলনামায় এ সওয়াব পৌঁছাতে থাকবে।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।’ (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ: ৪৭৯; মুসনাদে আহমাদ: ৩/ ১৮৩)।
মুসনাদে আহমদের একটি হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করল, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর বিনিময়ে তাকে এই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিফল দান করবেন।’ গাছের প্রতিটি পাতা আল্লাহর জিকির করে। সেই জিকিরের সওয়াব রোপণকারীর আমলনামায় লেখা হয়। তাই, গাছ লাগাতে হবে, গাছের পরিচর্যা করতে হবে এবং অকারণে বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে। অপ্রয়োজনে বৃক্ষনিধন করাকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ : ৫২৪১)। এছাড়াও হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) অযথা কোনো গাছের পাতা ছিঁড়তেও নিষেধ করেছেন।
দুনিয়াবি অনেক কাজের ক্ষেত্রেই সে কাজের প্রতি গুরুত্বারোপের সঙ্গে সঙ্গে নবীজি তাঁর সাহাবিদের মানসিকতাকে আখেরাতমুখী করেছেন। বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রেও নবীজি এমনটি করেছেন। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) একদিন গাছ লাগাচ্ছিলেন। এমন সময় নবীজি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, আবু হুরাইরা! কী লাগাচ্ছ? তিনি বললেন, একটি চারা রোপণ করছি। নবীজি বললেন, আমি কি তোমাকে এর চেয়ে উত্তম রোপণের কথা বলে দেব? আবু হুরায়রা বললেন, আল্লাহর রাসুল! অবশ্যই বলুন। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর প্রতিটির বিনিময়ে জান্নাতে তোমার জন্য একটি করে গাছ লাগানো হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৮০৭)।
রাসুল (সা.) নিজ হাতে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করেছেন। বৃক্ষরোপণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব মহানবী (সা.)-এর বিশেষ আমল। তিনি নিজে বৃক্ষরোপণ ও তার পরিচর্যা করতে মানুষকে উৎসাহিত করেছেন। বিপন্ন পরিবেশকে বাঁচাতে ও সুন্দর করে গড়ে তুলতে হলে আমাদেরকে বৃক্ষরোপণে মনযোগী হতে হবে।
নবীজি (সা.) বৃক্ষরাজি খুবই ভালোবাসতেন। মহানবী (সা.) নিজ হাতে গাছ লাগিয়েছেন, গাছের পরিচর্যা করেছেন এবং গাছ লাগানোর জন্য অন্যদের উৎসাহিত করেছেন। রাসুল (সা.)-এর সাহাবিরাও গাছ লাগাতেন। বর্তমান পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধে তথা মানবসভ্যতার সুরক্ষার জন্য মহানবী (সা.)–এর মহান সুন্নাত বৃক্ষরোপণ অতীব প্রয়োজন।
আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রকৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। হাজারো প্রজাতির প্রান-প্রকৃতির মিলনমেলায় নদীমাতৃক এই দেশটি হয়ে উঠেছে সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এক অনিন্দ্য সুন্দর দেশে। সবুজেই সেজেছে আমাদের পতাকা; সবুজেই যেন এর পরিচয়। কবির ভাষায়- “এদেশের সবুজ মাঠে, সবুজ ঘাটে, সবুজ বনে মদিনার সবুজ মিনার ঝলসে উঠে দুই নয়নে”।
কিন্তু আজ বাংলাদেশে পরিবেশ-প্রতিবেশব্যবস্থা নানামুখী বিপর্যয়ের সম্মুখীন। আমাদের নদ-নদী দখল, ভরাট ও দূষণে আক্রান্ত। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পকারখানার দূষণ ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতি আজ বিপন্ন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। বিভিন্ন দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে গড় তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, বায়ুপ্রবাহ আর হারিয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক ঋতু বৈচিত্র্য। সব মিলিয়ে আমরা আজ পরিবেশগত এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
এদেশের পরিবেশগত বিপর্যয়ের পেছনে যেমন রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির অপব্যবহার কে দায়ী করা হচ্ছে ঠিক তেমনি পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক কর্মীদের অংশগ্রহণ একটি কার্যকর পন্থা। এদেশের গণমানুষের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসাবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী যুব আন্দোলনও দেশের স্বার্থে জনগণের কল্যাণার্থে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
এ দায়বদ্ধতা থেকেই বিগত বছরের ন্যায় এ বছরও ইসলামী যুব আন্দোলন-এর আহবানে দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বছর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিটি সমন্বিত ও সুগঠিত করার জন্যই আগামী ২৬ জুলাই সারাদেশে একযোগে ১ লক্ষ বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছ লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আমি, সারা দেশের ইসলামী যুব আন্দোলন-এর সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ কর্মসূচিকে সাফল্যমণ্ডিত করতে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি। সেইসাথে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার চালিয়ে বৃক্ষরোপণে সাধারণ জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করে দেশের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে সচেতন করে তুলতে হবে। বৃক্ষরোপণকে একটি পবিত্র ইবাদত হিসেবে গণ্য করে, এ সকলের কাজে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া কামনা করছি।
লেখক : ইমতিয়াজ আহমাদ
কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পাদক
ইসলামী যুব আন্দোলন বাংলাদেশ
সেশন : ২০২৩-২৪