বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২১ উপলক্ষে ইসলামী যুব আন্দোলন-এর আয়োজনে “পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে যুব সমাজের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধ
প্রেক্ষাপট :
বর্তমানে পৃথিবী জুড়ে একটি আন্দোলন চলছে। তা হলো কীভাবে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে এই পৃথিবী নামক গ্রহকে রক্ষা করা যায়। এই তৎপরতার ফলে ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম জাতিসংঘের উদ্যোগে স্টকহোমে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং এর পর থেকে প্রতি বছর ৫ জুন দিনটি বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই সম্মেলনের দু’দশক পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত হয় পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ে দ্বিতীয় সম্মেলন যা ধরিত্রী সম্মেলন (Earth Summit) নামে অধিক পরিচিত। এ দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনসাধারণ তাঁদের পরিবেশের ভারসাম্য, পরিবেশের বিপর্যয় এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কে যাতে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং পরিবেশগত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে যাতে এগিয়ে আসেন, সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা। এ বছরে দিবসের ইংরেজি প্রতিপাদ্য ও স্লোগান হলো- ‘Ecosystem Restoration’ এবং ‘Join # Generation Restoration’ যার বাংলা ভাবানুবাদ করা হয়েছে যথাক্রমে ‘প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার’ এবং ‘প্রকৃতি সংরক্ষণ করি, প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করি’।
বাংলাদেশের পরিবেশ :
বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবেশ – প্রতিবেশব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেমে আসে বিপর্যয়। প্রকৃতিতে নদ-নদী, হাওর, পাহাড়, বন, ইত্যাদির ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে আমরা প্রতিনিয়ত এগুলো ধ্বংস করে চলেছি। নদ-নদী দখল-ভরাট-দূষণ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, দারিদ্র, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পানি ও বায়ু দূষণ, শিল্পকারখানার দূষণ, মাএাতিরিক্ত ও ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার, ভূগর্ভস্থ পানির অত্যাধিক উত্তোলনে বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। বিভিন্ন দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে গড় তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, বায়ুপ্রবাহ আর হারিয়ে যাচ্ছে স্বাভাবিক ঋতু বৈচিত্র্য। জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে আবাসন; কমছে কৃষি জমি। বিনাশ হয়ে যাচ্ছে বন, উধাও হয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। সব মিলিয়ে আমরা আজ পরিবেশগত এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
বাংলাদেশে ১৯৭০ সালে গঠিত পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডকে ১৯৭৭ সালে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়। ১৯৮৯ সালে বন বিভাগ এবং নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। ১৯৯২ সালে প্রথমবারের মত প্রণীত হয় জাতীয় পরিবেশ নীতি; এবং ১৯৯৫ সালে পরিবেশের সামগ্রিকদিক বিবেচনায় প্রণীত হয় ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন’। বাংলাদেশে এযাবৎ প্রণীত হওয়া পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের সংখ্যা ২২০ টি। এছাড়াও, পরিবেশ সংক্রান্ত প্রায় ৩০ টি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বাংলাদেশ পক্ষভুক্ত রাষ্ট্র। যেসব চুক্তির আলোকে দেশীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণে বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ। এতোসব আইন, নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার সত্ত্বেও বাংলাদেশের পরিবেশ পরিস্থিতি ক্রম-অবনতিশীল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইনের অপর্যাপ্ততা কোন সমস্যা নয়, বরং বিদ্যমান আইনের প্রয়োগহীনতা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা ও উদাসীনতাই উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ক-এ বলা হয়েছে “রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।” অর্থাৎ এসব সম্পত্তির মালিক বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নাগরিকগণ। নাগরিকের এই মালিকানা সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত এবং সুরক্ষিত।
অপরদিকে অনুচ্ছেদ ২১ মোতাবেক জাতীয় সম্পত্তি (Public Property) রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। ‘জাতীয় সম্পত্তি (Public Property)’ হল- পরিবেশ, জলবায়ু, জলাভূমি তথা সমুদ্র, সমুদ্র সৈকত, নদ-নদী, নদীর পাড়, খাল-বিল, খাল-বিলের পাড়, হাওর, বাওর, ঝিল, নালা, ঝিরি, সকল উন্মুক্ত জলাশয়, পাহাড়, পর্বত, বন, বন্য প্রাণী, বাতাস ইত্যাদিসহ এমন সকল সম্পদ যা প্রকৃততিে পাওয়া যায়। এসব সম্পত্তি সকলের এবং এসবের উপর প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার। এবং এগুলো রক্ষণাবক্ষেণরে দায়ত্বিও সকলরে।
হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য (২০১৯) মামলার রায়ে হাইর্কোট বভিাগ র্কতৃক প্রদত্ত দুটি র্পযবক্ষেণ ও একটি নর্দিশেনা উল্লখে করা হলো–
ুবিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিবেদন হতে বাংলাদেশের জনগণ দেখছে কিভাবে তুরাগ নদীসহ বাংলাদেশের সকল নদ-নদী, খাল-বিল, সমুদ্রের তীর, নদ-নদীর পাড়, হাওর-বাওর, নালা, ঝিল এবং উন্মুক্ত জলাশয় বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানী, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং বিত্তশালী ব্যক্তিরা দূষণ করে এবং অবৈধভাবে মাটি ভরাট করে এবং ভবনাদি নির্মাণ করে দখল করেছে এবং উক্ত দূষণ, মাটি ভরাট এবং ভবনাদি নির্মাণ এখনও চলমান।” (পৃষ্ঠা ২৭৭)
জাতিসংঘ কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে “Champions of the Earth” ঘোষণা করা হয়েছে অথচ তা সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সকল কর্ম প্রচেষ্টা ম্লান হয়ে যাচ্ছে দেশ বিরোধী গুটি কয়েক অবৈধ দূষনকারী ও দখলদার এবং তাদের সহযোগী হাতে গোনা কিছু জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জন্য।” (পৃষ্ঠা ২৭৭)
জাতীয় সম্পত্তি (Public Property) দখলকার এবং দূষণকারী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশের সকল ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর অযোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে আগামী ৬ মাসের মধ্যে অত্র বিভাগকে হলফনামা সম্পাদনের মাধ্যমে অবহিত করণের জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ প্রদান করা হল।” (পৃষ্ঠা ২৮১)
উচ্চ আদালতের এই পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনায় এটি প্রতীয়মান হয় যে, পরিবেশ দূষণে যেমন রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির অপব্যবহার করা হচ্ছে ঠিক তেমনি পরিবেশ সংরক্ষণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক কর্মীদের অংশগ্রহণ একটি কার্যকর পন্থা।
জাতীয় যুব নীতি ২০১৭-এর অনুচ্ছেদ ১১-তে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বিষয়ে যুব সমাজের সচেতনতা, এ প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্ততা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে স্বেচ্ছা শ্রমে যুবদের উদ্বুদ্ধ করার প্রতি গুরুত্বারোপের কথা বলা হয়েছে।
এ দায়বদ্ধতা থেকেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২১ উপলক্ষে ইসলামী যুব আন্দোলন-এর আয়োজনে “পরিবেশ, প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে যুব সমাজের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
পরিবেশ ও রাজনৈতিক দলের ভূমিকা:
বাংলাদশেরে এই অবনতিশীল ও ক্ষয়িষ্ণু পরিবেশকে রক্ষায় সর্বসম্মত ঐক্য একান্ত প্রয়োজন। বলাবাহুল্য, সর্বস্তরের প্রতিষ্ঠান ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এ লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না। তদুপরি পরিবেশ রক্ষায় রাজনৈতিক অঙ্গিকার ও সদিচ্ছা একটি অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত। কেননা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই জনগণকে সম্পৃক্ত ও সচেতন করা সহজ।
পৃথিবীর দরিদ্র দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নীচের দিকেই পাওয়া যায়। দারিদ্র থেকে মুক্তির জন্য এ দেশটিতে অগ্রগতি ও উন্নয়নের প্রয়াস চলছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাথে পরিবেশ অবক্ষয়ের একটি যোগসূত্র আছে। উন্নয়নের প্রধান তিনটি অংশÑ নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং কৃষির আধুনিকায়নের পরিবেশ অবক্ষয়ে রয়েছে উল্লেখযোগ্য ও প্রমাণিত ভূমিকা। ফলে সীমিত সম্পদ, বিপুল জনসংখ্যা আর প্রাকৃতিকভাবে নাজুক অবস্থানের বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র বিমোচন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচেষ্টা পরিবেশের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এ আশংকা সবসময়ই রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশের পরিবেশের অবক্ষয় ও এর ভঙ্গুরতা প্রকাশ পেয়েছে অথচ একথা বড়ই সত্যি যে অবনতিশীল পরিবেশের উপর উন্নয়ন টিকে থাকতে পারে না, আবার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সবধরণের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে না। অতএব, পরিবেশকে রক্ষা করেই মানুষের উন্নয়ন করতে হবে যাকে টেকসই উন্নয়ন (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ) বলা হয়। এটাই হচ্ছে আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এতোদিন ধরে উন্নয়নের যে মডেল আমরা অনুসরণ করে আসছিলাম তাতে উন্নয়ন চলেছে কিন্তু পরিবেশের প্রভাবগুলো ঠিকভাবে দেখা হয় নাই। আর পরিবেশের যদি কোন ক্ষতি হয়েছে ওটাকে আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি ‘অং ধ পড়ংঃ ড়ভ ফবাবষড়ঢ়সবহঃ’ হিসাবে। এভাবে আর চলতে পারে না। একই সাথে একথা সত্যি যে লাগসই অর্থনীতি ও সুস্থ রাজনীতি ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের সাথে সরকারি, বেসরকারি ও বিভিন্নস্তরের জনগণ জড়িত আছে। সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরর্বিতন মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরসমূহ (পরিবেশ, বন ও মৎস) রয়েছে। বিভিন্ন এন.জি.ও এবং ব্যক্তি বিশেষও এ লক্ষ্যে কাজ করছেন। কিন্তু এখনও এই সার্বিক কাজের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং প্রায়ই তা অসমন্বিত, দিক নির্দেশনাহীন এবং কারিগরীভাবে অযথাযথ। এর অন্যতম কারণ হলো দেশের পরিবেশ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে সঠিক রাজনৈতিক অঙ্গিকার এবং সদিচ্ছার অভাব।
পরিবেশ সংরক্ষণ এককভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দায়িত্ব নয়, বিষয়টি যেহেতু সামষ্টিক, সেহেতু জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি আর এজন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গিকার। রাজনীতিকরা যেহেতু ক্ষমতার বলয়ে থাকেন এবং তারাই দেশের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারকের ভূমিকা সংসদে এবং অন্যান্য মাধ্যমে পালন করতে পারেন, তাই পরিবেশ সংরক্ষণে তাদের সদিচ্ছা ও অঙ্গীকারের কোন বিকল্প নেই। সেজন্যই রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকা অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনভুক্ত। নির্বাচন কমিশন প্রাগ্রসরভাবে চিন্তা করলে সকল রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বা নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত হিসাবে গঠনতন্ত্র বা নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে বাধ্যতামূলক করে দিতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের অনুচ্ছেদ ৩২-এ পরিবেশ সম্পর্কে তাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের উল্লেখ রয়েছে-
“৩২। পরিবেশ
ক। পরিবেশ সংরক্ষণের এবং পরিবেশ দূষণ নিরসনের ক্ষেত্রে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খ। অবাধে গাছ কাটা ও পাহাড় কাটা বন্ধ করা হবে।
গ। প্রতিটি বাড়িতে বছরে কমপক্ষে ১০ টি বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করা হবে।
ঘ। বুড়িগঙ্গাসহ সকল নদী ও খালকে দূষণ ও দখল মুক্ত করা হবে।”
সম্প্রতি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদে সৃজন করা হয়েছে “স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক” পদ। যা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ যোগ্য।
বাংলাদেশে পরিবেশ অবক্ষয় সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনাবলি যেমন- নদ-নদী, প্রাকৃতিক জলাধার দখল-দূষণ, নদী থেকে অনিয়ন্ত্রিত বালু বা পাথর উত্তোলন, বন উজাড় কিংবা বনভূমি দখল, পাহাড়কাটা, অনিয়ন্ত্রিত জাহাজ ভাঙ্গা কিংবা নিয়মবহির্ভূতভাবে শিল্প-কারখানা পরিচালনা করা ইত্যাদির সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এসব নির্মূলে রাজনৈতিক দলসমূহ ও নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালী ভূমিকা একান্ত আবশ্যক।
বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনাবলি যেমন- ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ, টেংরাটিলা বিস্ফোরণ, মাগুরছড়া বিস্ফোরণ, ফুলবাড়ি কয়লাখনি, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি বিষয়ে ক্ষমতার বাহিরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকেই সাধারণত পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে বেশি তৎপর দেখা যায় কিন্তু ক্ষমতাসীনদের একটু উদাসীনই থাকতে দেখা যায়।
বাংলাদেশে একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিয়ে আন্তর্জাতিক বা আন্ত-রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন- আন্তরাষ্ট্রিয় নদী বা নদীর পানি সমস্যা নিরসন, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত বা ঝুঁকিপ্রবণ দেশ বাংলাদেশ; পরিবেশ কূটনীতির মাধ্যমে দূষণকারী দেশসমূহের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি ও আদায় ইত্যাদি। সর্বোপরি পরিবেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রাজনৈতিক দলের জন্য, শুধুমাত্র জনগণকে কাছে আনবার জন্য নয়, দেশের উন্নতি করার জন্য, দেশকে বাঁচাবার জন্য।
বাংলাদেশে পরিবেশবাদের চ্যালেঞ্জসমূহ :
আইনের বাস্তবায়নহীনতা (Lack of implementation)
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব (Lack of political will)
দুঃশাসন (Mal-governance)
পরিবেশগত সংবেদনশীলতার অভাব (Lack of environmental sensitivity)
কর্পোরেট মিডিয়া (Corporate media)
স্বার্থের দ্বন্দ্ব (Conflict of interest)
নিয়মিত পরিবীক্ষণের অভাব (Lack of regular monitoring)
তথ্য প্রাপ্তিতে বাধা (Non-access to information)
প্রয়োজনীয় সহযোগী আইনের অনুপস্থিতি (Absence of necessary bylaws)
স্থানীয় সম্প্রদায়ের অনৈক্য (Lack of organization at the Community)
অর্থ ও পেশী শক্তি (Money and muscle power)
পরিবেশ সংরক্ষণে প্রস্তাবনাসমূহ :
১। সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি পূরণকল্পে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করতে হবে।
২। দেশের সকল শহর ও নগরাঞ্চলের সবুজ আচ্ছাদন, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সেইসাথে পানি সরবরাহ ও পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণ এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্য সংরক্ষণে পরিকল্পিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩। বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণসহ পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইন সমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং পরিবেশ সংক্রান্ত অপরাধের বিচার ত্বারান্বিত করতে প্রতিষ্ঠিত পরিবেশ আদালত সমূহে জনসাধারণের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
৪। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় প্রতিষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড-এর অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে, এবং সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাঠামো গড়ে তোলার পাশা-পাশি দুর্যোগের সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৫। পলিথিন শপিং ব্যাগসহ অন্যান্য কৃত্রিম মোড়কের ব্যবহার নিরোধ করে পাটজাত ও অন্যান্য পরিবেশ বান্ধব মোড়কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৬। দেশের সকল নদ-নদীকে অবৈধ দখল, শিল্প কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম থেকে রক্ষা করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার ও নৌ-পরিবহনযোগ্যতা ঠিক রেখে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৭। দেশের পানি সম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে সবার জন্য সুপেয় পানির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে, এবং ভূগর্ভস্থ পানির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
৮। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারের মাধ্যমে জ্বালানি সংরক্ষণ ও তার দক্ষ ব্যবহার করে জ্বালানির অপচয় রোধ করতে হবে।
৯। অপরিকল্পিত বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা বা রাস্তাঘাট তৈরি রোধ করে ভূমির প্রকৃতি ঠিক রেখে পরিবেশ ও খাদ্য শস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে কৃষি জমির সুরক্ষাসহ ভূমির পরিকল্পিত ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
১০। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিবেশের অবক্ষয় যেমন– দেশের নদ-নদী ও প্রাকৃতিক জলাধার দখল, নদী থেকে অনিয়ন্ত্রিত বালু-পাথর উত্তোলন, বন উজাড় কিংবা বনভূমি দখল, পাহাড় কাটা, অনিয়ন্ত্রিত জাহাজ ভাঙ্গা, কিংবা নিয়ম বহির্ভূতভাবে শিল্প-কারখানা পরিচালনা ইত্যাদি নিরোধ করতে হবে।
১১। আন্ত-রাষ্ট্রীয় নদীর পানি বণ্টন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলাসহ পরিবেশ সংক্রান্ত বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর নিরসনে দায়ী দেশ গুলোর দায়বদ্ধতা এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জন্য ক্ষতিপূরণ ও প্রয়োজনীয় কারিগরি সহযোগিতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।
সর্বোপরি, বিভিন্ন মাধ্যমে পরিবেশ বিষয়ক প্রচার-প্রচারণা ও পরিবেশ শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে সাধারণ জনগণকে পরিবেশ সচেতন করে তুলতে হবে।
লেখক : ইমতিয়াজ আহমেদ সজল
গবেষক ও পরিবেশ আইনবিদ